ইউনানি-আয়ুর্বেদ ওষুধে সয়লাব বাজার! হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

 

নুরে আলম পারভেজ: আগে হাস্যরস করে বলা হতো, ইউনানি-আয়ুর্বেদ মেডিসিন মানে রঙ, পানি, স্যাকারিন। বর্তমানে তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে সিলডেনাফিল সাইট্রেড, ডেক্সামেথাসনের মতো ক্ষতিকর ও সস্তা কেমিক্যাল। অতি মুনাফার লোভে ভেষজ বাদ দিয়ে কেমিক্যাল ব্যবহার হচ্ছে দেদারসে। ফর্মুলারি অনুযায়ী নির্ধারিত ভেষজ উপকরণের পরিবর্তে নানা তিকর কেমিক্যাল ব্যবহৃত হচ্ছে। সূত্রমতে, দেশে লাইসেন্স প্রাপ্ত ইউনানি ওষুধ কোম্পানি ২৬৬টি এবং আয়ুর্বেদ ওষুধ কোম্পানি ২০৫টি। এর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী কিছু কোম্পানি ফর্মুলারি অনুযায়ী ওষুধ তৈরি করলেও বেশিরভাগ কোম্পানিই ফর্মুলারির বাইরে গিয়ে অতি মুনাফার লোভে নানা ধরনের তিকর কেমিক্যাল ব্যবহার করছে। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। পেশাদার ডিগ্রিধারী হাকিম কবিরাজদের স্থান দখল করেছে কেমিস্টরা। নামধারী কয়েকজন কেমিস্টের সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা হার্বসের পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট কেমিক্যাল ব্যবহারের নিয়ম বাতলিয়ে থাকে। তবে এখন অনেক হাকিম কবিরাজও কেমিক্যাল বিদ্যা রপ্ত করে অসৎ কাজে লিপ্ত হয়েছে। স্বার্থান্বেষী কিছু ব্যবসায়ী ও হাতুড়ে বৈদ্যের অনুপ্রবেশের ফলে এই শিল্পে এত জাল জালিয়াতি। এই ওষুধশিল্প ভ্যাটমুক্ত হওয়ায় এবং স্বল্প পুঁজিতে ব্যবসা করা যায় বলে অসৎ ব্যবসায়ী, হকার, হাতুড়ে বৈদ্য সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। এক ব্যক্তি একাধিক কোম্পানির মালিক। চিকিৎসার নামে প্রতারণার অভিযোগে র‌্যাবের হাতে আটক হওয়া কলিকাতা হারবালের মালিকও এখন লাইসেন্স প্রাপ্ত কোম্পানির মালিক! হকার মিজানও এখন আয়ুর্বেদ শিল্প সমিতির নেতৃত্ব দিচ্ছে। শহরের শিক্ষিত সমাজে তাদের ওষুধ বিক্রি হয় না। তাদের টার্গেট গ্রামের অশিক্ষিত মানুষ ও ফুটপাত, বস্তির অসচেতন মানুষ। ওষুধ আইনে এমএলএম ও হকারি করে ওষুধ বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও কিছু ইউনানি-আয়ুর্বেদ কোম্পানি এমএলএম সিস্টেমে ও হকারি করে ফুটপাতে ওষুধ বিক্রি করে। এমনকি ফুটপাতে ইঁদুর মারার ওষুধ বিক্রেতার কাছেও ইউনানি-আয়ুর্বেদ ওষুধ বিশেষ করে যৌনশক্তিবর্ধক ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে। হকারি করে ওষুধ বিক্রয়ের শীর্ষে রয়েছে গ্রিন লাইফ ন্যাচারাল হেলথ কেয়ার ও হাইম্যাক্স ইউনানি ফার্মাসিউটিক্যালস। এমএলএম সিস্টেমে ওষুধ বিক্রয়ের শীর্ষে রয়েছে মডার্ন হারবাল। অন্যদিকে ইউনানি-আয়ুর্বেদ কোম্পানির নাম ও ওষুধের ট্রেড নামেও মানুষ বিভ্রান্ত হয়। এসব কোম্পানি নামের সাথে ফার্মাসিউটিক্যালস যোগ করায় সাধারণ মানুষ অ্যালোপ্যাথিক কোম্পানি মনে করে ভুল করে। চতুর কোম্পানিগুলো ওষুধের মোড়কে খুব ছোট করে ইউনানি আয়ুর্বেদ লিখে রাখে। সম্প্রতি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এসব কোম্পানির নামের সাথে ফার্মাসিউটিক্যালস শব্দ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু অধিকাংশ কোম্পানি এই আদেশ পালন করছে না। রয়েছে ট্রেড নামের সমস্যা। এ ধরনের কিছু কোম্পানি রীতি অনুযায়ী চন্দনাসব, অর্জুনারিস্ট, তিলাযাদিদ, হাব্বে নিশাত এরকম ট্রেড নাম ব্যবহার না করে হরমো প্লাস, ভায়াজিন, হরমোজিনের মতো ইংরেজি ট্রেড নাম ব্যবহার করায় জনসাধারণ এটাকে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ মনে করে বিভ্রান্ত হয়। ট্রেড নামের ক্ষেত্রে ইউনানি আয়ুর্বেদ ঐতিহ্য অনুসরণ করা উচিত বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
ওষুধের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রেও অরাজকতা বিরাজ করে এখানে। ভেজাল ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের সস্তায় তৈরি ওষুধ বিক্রেতাদের ৫০ থেকে ৮০ ভাগ কমিশন দিয়ে বিক্রি করে! বিশেষজ্ঞদের মতে, ৫০ বা ৮০ ভাগ কমিশনে বিক্রয় করা ওষুধে হার্বস ব্যবহার সম্ভব নয়। রঙ, পানি, স্যাকারিন ও কেমিক্যাল যোগে তৈরি হলেই এটা সম্ভব। তারা মনে করেন, ইউনানি-আয়ুর্বেদ কোম্পানির বিক্রয় কমিশন অ্যালোপ্যাথিক কোম্পানির সমান হওয়া উচিত।বর্তমানে ইউনানি আয়ুর্বেদ ওষুধশিল্পে বহুল আলোচিত বিষয় হচ্ছে সিলডেনাফিল সাইট্রেড ও ডেক্সামেথাসন সালফেট। বর্তমান যুগে অবশ্য যৌনশক্তিবর্ধক ওষুধের ব্যবসা তুঙ্গে। ইউনানি আয়ুর্বেদের যৌনশক্তিবর্ধক ওষুধ দীর্ঘ মেয়াদে খুবই কার্যকর, যার কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। কিন্তু অসচেতন মানুষ দীর্ঘ মেয়াদের সমাধানের পরিবর্তে ত্বরিত সমাধানের দিকে ঝুঁকছে। আর সমাধানের নাম সিলডেনাফিল সাইট্রেডের মতো কেমিক্যাল। এই কেমিক্যাল যোগে তৈরি ওষুধ যৌন সমতায় ত্বরিত কাজ করলেও দীর্ঘ মেয়াদে মানবদেহের অঙ্গ- প্রত্যঙ্গের নানা ক্ষতি করে। এক পর্যায়ে যৌনমতা সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তারপরও যৌনশক্তিবর্ধক ওষুধের ব্যবসা এখন রমরমা।
অন্যদিকে মোটা হওয়ার ওষুধে ব্যবহার হচ্ছে ডেক্সামেথাসন সালফেট। ইউনানি-আয়ুর্বেদ ওষুধ শাস্ত্রের ইমেজ ও মানবস্বাস্থ্যের হিতাহিত চিন্তা না করে কতিপয় ইউনানি-আয়ুর্বেদ ওষুধ কোম্পানির কিছু মালিক এই রমরমা ব্যবসায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, কেমিক্যাল ব্যবহারকারী কোম্পানির ব্যবসা এখন বেশ রমরমা। অনেক হকার ও হাতুড়ে বৈদ্য কোম্পানির মালিক হয়ে আঙুল ফুলে কলা গাছ বনে গেছে। মানবস্বাস্থ্যের তি করে হয়েছে টাকার কুমির।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, যৌনশক্তিবর্ধক ওষুধ তৈরির জন্য সরকার স্বীকৃত ইউনানি-আয়ুর্বেদ ফর্মুলায় একাধিক রেসিপি রয়েছে। আয়ুর্বেদ ফর্মুলারিতে অন্যতম রেসিপি হচ্ছে যৌবন শতদল (বাজী করনাধিকার)। যৌবন শতদল রেসিপির ১৫টি উপকরণ হচ্ছে রস সিন্দুর, স্বর্ণ, মুক্তা, বঙ্গ, অশ্বগন্ধা, আলকুশি, আকর করভ, জাফরান, যায়ত্রী, লবঙ্গ, শুঠ, পিপুল, রক্ত চন্দন, অহিফেন। অন্যান্য রেসিপির উপকরণও প্রায় কাছাকাছি। অন্যদিকে ইউনানি ফর্মুলারির একাধিক রেসিপির মধ্যে হাব্বে-নিশাত অন্যতম। হাব্বে-নিশাত রেসিপির ৯টি উপকরণ হচ্ছে বিসবাহা, রেগমাহী, সমুন্দর সুখ, জৌযবুওয়া, কুশত নুকরা, জাফরান, যহর মোহরা, জুন্দবেদস্তর ও আবে বর্গে তাম্বুল। অন্যান্য ইউনানি রেসিপির উপাদান প্রায় অভিন্ন। কিন্তু মুনাফাখোর বিপথগামী ব্যবসায়ীরা উপরোক্ত উপকরণের পরিবর্তে ব্যবহার করে সিলডেনাফিল সাইট্রেড কেমিক্যাল। যদিও ওষুধের লেবেল কার্টুনে ইউনানি-আয়ুর্বেদ রেসিপির উপকরণ লেখা থাকে। অভিযোগ রয়েছে, জাল জালিয়াতি বা অন্য কোনো উপায়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে এরা অনুমোদন নিয়ে থাকে।

বিশ্লেষকদের মতে, যৌন শক্তিবর্ধক ওষুধ যদি ইউনানি আয়ুর্বেদ ফর্মুলায় তৈরি হয় তাহলে কার্যকারিতা পাওয়া যাবে কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর, যা টেকসই। আর যদি ওষুধের কার্যকারিতা এক থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে হয় তাহলে বুঝতে হবে এটা ইউনানি আয়ুর্বেদ ওষুধ নয়। আর বাকিটা নিশ্চিত হওয়া যাবে ল্যাবরেটরিতে পরিক্ষার পর।

ভেজাল ওষুধ ব্যবসায়ী আর প্রশাসনের মধ্যে প্রায়ই চোর-পুলিশ খেলা হয়। লেনদেনে কোনো সমস্যা হলে ল্যাবরেটরিতে ওষুধ পরীক্ষার করে কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। জালিয়াত কোম্পানিগুলো শঠতার আশ্রয় নেয়। বলে, এই ওষুধ আমাদের উৎপাদিত নয়; কোনো জালিয়াত চক্র আমাদের নামে ওষুধ উৎপাদন করে বাজারজাত করছে। সম্প্রতি মডার্ন হারবালের যৌনশক্তিবর্ধক ওষুধ ‘কস্তুুরি সুপার’ ঔষধ প্রশাসন পরীক্ষাগারে ভেজাল প্রমাণিত হলে প্রতিষ্ঠানটি ‘ওষুধটি আমাদের উৎপাদিত নয়, আমাদের নামে অন্য কেউ হয়ত বাজারজাত করছে!’ দাবি করে থানায় জিডি দায়ের করে। আরো কয়েকটি কোম্পানি এ ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে।

অনির্বান ফার্মাসিউটিক্যালসের সিলগোল্ড, মডার্ন হারবালের কস্তুরি সুপার, ম্যানসন্স ফার্মাসিউটিক্যালস’র সাসটিনা, ম্যানভিক্যাপ। নেপচুন ল্যাবরেটরীজ’র নিশাত সিলভার। ছাদেক ফার্মাসিউটিক্যালস’র লিজাডেক। রাসনা ফার্মাসিউটিক্যালস’র রাসকিং। লিড ফার্মাসিউটিক্যালস’র লিডোগোল্ড। ডীপলেইড ফার্মাকো’র লিবোনেক্স, ভিমেক্স প্লাস। এসবি ল্যাবরেটরীজ’র পাওয়ার ৩০। পপি ফার্মাসিউটিক্যালস্’র পি জিনসেং । গ্রিন লাইফ নেচারাল হেলথ কেয়ারের ফুর্তি ম্যাক্স।

হাইম্যাক্স ইউনানি ফার্মাসিউটিক্যালসের নাইট পিল (ট্রেড নামের অনুমোদন নেই) নোবেল ইউনানি ল্যাবরেটরিজ’র গামা-এক্স, দিদার আয়ুর্বেদিক ফার্মাসিউটিক্যালসের যৌবন শতদল, রতি বিলাসসহ অনেক কোম্পানির যৌনশক্তিবর্ধক ওষুধের ব্যবহারিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয় এগুলো ইউনানি-আয়ুর্বেদ ফর্মুলায় তৈরি নয়। কেননা উক্ত ওষুধসমূহের কার্যকারিতা শুরু হয় এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে, যা ভেষজ ওষুধের বৈশিষ্ট্য নয়। কিছু কোম্পানির ওষুধ নির্দেশিকায় লেখা রয়েছে প্রয়োজনের এক ঘণ্টা পূর্বে সেবন করতে হবে। উল্লেখিত ওষুধগুলোর বিক্রেতাদের (ফুটপাত ও ওষুধের দোকান) সাথে কথা বললে তারা সেবনের ১ ঘণ্টার মধ্যে কার্যকারিতার নিশ্চয়তা দেন। অন্যদিকে একাধিক ব্যবহারকারী ১ থেকে ৩ ঘণ্টার মধ্যে কার্যকারিতার কথা স্বীকার করেছেন। তবে উক্ত ওষুধ দীর্ঘ দিন ব্যবহারের ফলে শরীরে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাবের কথাও বলেছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, তাদের নিজস্ব উদ্যোগে ল্যাবরেটরিতে ইউনানি-আয়ুর্বেদ ওষুধের কিছু নমুনা ইতঃপূর্বে পরীা করা হয়েছে। তাতে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ফর্মুলারি বহির্ভূত রাসায়নিক উপাদান ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক রহুল আমিন সাংবাদিক নুরে আলম (পারভেজ) এর সাথে আলাপকালে আনন্দ ফুর্তি’র মতো ট্রেড নামের ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ওষুধ এমন কোনো পণ্য নয়, যা ফুটপাতে বা এমএলএম সিস্টেমে বিক্রি করা যায়। দেশের বিদ্যমান আইন ও নীতিমালায় তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ভেজাল চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এমতাবস্থায়, জনস্বার্থে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে এক্ষেত্রে সক্রিয় হওয়ার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যান্য ওষুধের ন্যায় ইউনানি-আয়ুর্বেদ ঔষধ কোম্পানির কারখানা এবং বিক্রয় কেন্দ্রে নিয়মিত পরিদর্শন করে ওষুধের নমুনা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করার মাধ্যমে ভেজাল ও জালিয়াত কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। প্রয়োজনে ভেজাল কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করার পাশাপাশি জালিয়াতির মাধ্যমে তাদের অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার মতো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচি।