যশোরের অভয়নগরে নদী দখলের প্রতিযোগিতা

যশোর প্রতিনিধি, ক্রাইম ফাইল 

যশোরের অভয়নগরের ভৈরব নদী দখলে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও ঘাট মালিকরা। তারা নদীর নব্যতা সংকটের অজুহাত দেখিয়ে নদী দখলের প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। কৃত্রিম চর বানিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে প্রায় অর্ধশত ঘাট। ফলে নদীর কিছু কিছু স্থানের বাঁক পরিবর্তন হয়েছে। ভাঙনের কবলে নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে শতশত বিঘা ফসলি জমি। নিঃস্ব হয়েছে অনেক পরিবার। নওয়াপাড়া নদীবন্দর কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে সরকার হারাচ্ছে কোটি টাকার রাজস্ব।

ওদিকে, নদী তার আগের চেহারা ফিরে পাবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন নওয়াপাড়া নদীবন্দর কর্তৃপক্ষ। উপজেলা নির্বাহী কর্সকর্তা বলেছেন, সরকারি রাজস্ব বাড়াতে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অবৈধ দখলরোধে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না।

ব্যবসায়ী ও ঘাট মালিকরা বলছেন, নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে ঘাটে জাহাজ ও কার্গো ভিড়তে পারছে না। যে জন্য মাটি ও বালু ফেলে নদীর মধ্যে বাঁশ এবং কাঠ দিয়ে পন্টুন করতে হচ্ছে।

জানা গেছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার মুরটি গ্রামে পদ্মার শাখা জলঙ্গি থেকে বেরিয়ে ভৈরব নদ মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপর চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা, ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর এবং যশোর জেলার তাহিরপুর ও আফ্রা হয়ে ভৈরব নদ খুলনার পশুর নদীতে গিয়ে মিশেছে। তাহিরপুর থেকে খুলনার পশুর-ভৈরবের মিলনস্থল পর্যন্ত ভৈরবের মোট দৈর্ঘ্য ১৩৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে পশুর-ভৈরবের সঙ্গমস্থল থেকে যশোরের আফ্রা পর্যন্ত ভৈরবের ৩৭ কিলোমিটার প্রবাহমান আছে। যার মেধ্য প্রায় ২৫ কিলোমিটার অংশ রয়েছে অভয়নগরজুড়ে।

দেশের অন্যতম ব্যবসায়ী মোকাম হিসেবে অভয়নগরের নওয়াপাড়ার পরিচিতি দেশব্যাপী। এখানে নৌ, সড়ক ও রেল পথ থাকায় ব্যবসাসমৃদ্ধ শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে। যে কারণে নওয়াপাড়া নদীবন্দরের গুরুত্ব বিবেচনা করে বর্তমান সরকার এটিকে প্রথম শ্রেণির নদীবন্দর হিসেবে ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন। উপজেলার রাজঘাট থেকে বসুন্দিয়া ইউনিয়নের আফ্রা ঘাট পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার বিস্তৃত নওয়াপাড়া নদীবন্দর। এই ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে চলছে অবৈধ স্থাপনা ও নদী দখলের প্রতিযোগিতা।

নওয়াপাড়া নদীবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, ২০০৭ সাল থেকে তাদের কার্যক্রম শুরু। বর্তমানে ৯টি সরকারি জেটি আছে। এ ছাড়া ব্যক্তি মালিকানায় রয়েছে প্রায় এক শ ঘাট। ২০১৯-২০ অর্থবছরে নওয়াপাড়া নদীবন্দরের প্রায় ৫ কিলোমিটার (রাজঘাট থেকে ভাঙ্গাগেট) গাইডওয়াল নির্মাণ, স্থায়ী জেটি ও কাস্টম ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় এই পরিকল্পনার অনুমোদন দিলে সরকারি রাজস্ব অনেকাংশে বেড়ে যাবে।

সরেজিমনে নওয়াপাড়া নদীবন্দরের ভাঙ্গাগেট মশরহাটি গ্রামে ভৈরব সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদীতীরবর্তী পরশ আটা, ময়দা, সুজি মিল নামক একটি প্রতিষ্ঠান নদের প্রায় এক শ ফুটের মতো দখল করে ফেলেছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে কৃত্রিম চর বানিয়ে তার মধ্যে এস্কাভেটর লাগিয়ে মাটি ভরাট করছে। পাশেই আক্তার অ্যাগ্রো নামের একটি বন্ধ কারখানাও নদীর অর্ধেক প্রায় দখল করে ফেলেছে। তারা বাঁশের খুটি গেড়ে পুরাতন টিন দিয়ে নদীর মধ্যে বাঁধ দিয়েছে। পরে ইট, বালু, পাথর ও মাটি দিয়ে ভরাট করে চর উঠেছে বলে দখল করেছে। এরপর সেই স্থানে ঘাট নির্মাণ করার চেষ্টা করছে। তাদের এই নদী দখলের ফলে ওই স্থানে নদীর গতিপথ পাল্টে গেছে। যে কারণে নদীর অপর পাড়ে ব্যাপক ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে, যা এখনও অব্যাহত আছে।

ভাঙনকবলিত দিয়াপাড়া গ্রামবাসী অভিযোগ করেন, পরশ এবং আক্তার মিল কর্তৃপক্ষের নদী দখলের কারণে তাদের শতশত বিঘা জমি আজ নদীগর্ভে বিলিন হয়েছে। অনেক পরিবার হয়েছে নিঃস্ব। ভৈরব নদের এই স্থান এখন খালে পরিণত হয়েছে। নিঃস্ব পরিবারের পক্ষ থেকে নদীখেকোদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বলেন, আমাদের মতো গরিব পরিবারগুলো আজ ভূমিহীন হয়ে পড়েছে। আক্তার অ্যাগ্রো, পরশ মিলসহ নওয়াপাড়া বাজারের কয়েকজন প্রভবশালী ব্যবসায়ী ভৈরব নদী দখল করে নদীর বাঁক পাল্টে ফেলেছে। ফলে জোয়ারের পানি আমাদের জমিতে আঘাত হেনে ভাঙন সৃষ্টি করছে। এ ব্যাপারে তারা বিআইডাব্লিটিএ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনাসহ ক্ষতিপূরণ দাবি করেন।

কথা হয় পরশ আটা, ময়দা ও সুজি মিলের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমানের সাথে। তিনি নদীর নাব্যতা সংকটের অজুহাত দেখিয়ে বলেন, পণ্যবাহী জাহাজ বা কার্গো ঘাটে ভেড়ানো যায় না। নদীতে নতুন চর জেগেছে। যে কারণে একটু মাটি ভরাট করে পন্টুন করা হচ্ছে। সমস্যা হলে তা অপসারণ করা হবে। ওদিকে, বার বার চেষ্টা করেও আক্তার মিলের পরিচালক আব্দুল কুদ্দুসকে পাওয়া যায়নি।

নওয়াপাড়া নদীবন্দরের উপ-পরিচালক মাসুদ পারভেজ জানান, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও ঘাট মালিকরা অহেতুক নদীর নব্যতা সংকটের অজুহাত দেখাচ্ছেন। ভৈরব সেতুসংলগ্ন এলাকায় নদী খননের কাজ চলছে। আর এই খনন কাজ সারা বছর ধরে চলবে। যারা কৃত্রিম পন্থায় চর বানিয়ে নদী দখল করছে, তাদের তালিকা করে নোটিশ করা হয়েছে। প্রায় ৯০টি প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ করা হয়েছে, যার মধ্যে ৫৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। বাকিগুলোর বিরুদ্ধে অচিরেই কাজ শুরু করা হবে।

অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহীনুজ্জামান এ ব্যাপারে বলেন, বর্তমান সরকার দেশের প্রতিটি নদী রক্ষা ও তার পূর্বের রূপ ফিরিয়ে আনতে অভিযান শুরু করেছে। দখল করা স্থানে প্রথমে মাটি কাটা হবে, পরে ড্রেজিং এর মাধ্যমে ভৈরব নদীকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে। অবৈধ দখল করা জমি ফিরিয়ে আনাসহ নদী আইন মোতাবেক কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। ভৈরব সেতুসংলগ্ন নদীর মধ্যে যারা দখল প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং অবৈধ দখল উচ্ছেদে অভিযান চলবে।